আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির যুগেও কুড়িগ্রামের লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা ইউনিয়নের জমগ্রামের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ কৃষক মমিন মিয়া ঘোড়া দিয়ে হাল চাষ করছেন। গরু-মহিষ দিয়ে হাল চাষের ঐতিহ্য যেখানে প্রায় বিলুপ্ত, সেখানে মমিন মিয়া ঘোড়া দিয়ে জমি চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
এক সময় গ্রামীণ জনপদে সকালে লাঙ্গল-জোয়াল আর গরু নিয়ে মাঠে জমিতে যেতেন রাখালরা। দিনভর হাল চাষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরতেন। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে গ্রামে এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না। গরু-মহিষ দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে, এবং অধিকাংশ কৃষক এখন ট্রাক্টরের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৃদ্ধ মমিন মিয়া এখনও ঘোড়া দিয়ে হাল চাষের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
মমিন মিয়া যৌবনকাল থেকেই হাল চাষ ও কৃষি শ্রমিকের কাজ করে আসছেন। বর্তমানে গরু-মহিষের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় গরু কিনে হাল চাষ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। দুটি গরুর দাম প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এত বড় মূলধন জোগাড় করতে না পেরে তিনি বিকল্প হিসেবে ঘোড়া কিনেছেন। ঘোড়া দিয়ে হাল চাষ করা তার জন্য কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
মমিন মিয়া বলেন, “আমার নিজের কোনো জমি নেই। মানুষের জমিতে হাল চাষ করি। বিঘা প্রতি ৫০০ টাকা পাই। প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন বিঘা জমি চাষ করি। যা আয় হয়, তার কিছু অংশ ঘোড়ার খাবার কেনায় খরচ হয়, বাকিটা দিয়ে চার সদস্যের সংসার চালাই। গরুর চেয়ে ঘোড়ার গতি বেশি, তাই জমিও বেশি চাষ করা যায়।”
বাউরা এলাকার কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, “খোলা মাঠে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করা সম্ভব। কিন্তু খণ্ড খণ্ড জমিতে ট্রাক্টর নেয়া যায় না। সেই জমিগুলো চাষের জন্য মমিন মিয়ার ঘোড়ার হালই ভরসা। ট্রাক্টরের তুলনায় ঘোড়া দিয়ে চাষ করলে জমিতে মইও দেয়া যায়। এতে জমি সমান হয়।”
বাউরা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য মামুন হোসেন সরকার জানান, মমিন মিয়ার ঘোড়ার হাল এলাকার কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে তার বাড়িতে চারটি ঘোড়া রয়েছে। পালাক্রমে বিশ্রাম দিয়ে তিনি ঘোড়া দিয়ে হাল চাষ করেন।
পাটগ্রাম উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি অফিসার হারুন মিয়া বলেন, “বর্তমানে অধিকাংশ কৃষক উন্নত মানের কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জমি চাষ করেন। গরু-মহিষের হাল চাষ প্রায় বিলুপ্ত। সেখানে ঘোড়া দিয়ে হাল চাষের ঘটনা অত্যন্ত বিরল। মমিন মিয়া জীবিকার প্রয়োজনে অন্যের জমিতে ঘোড়া দিয়ে চাষ করছেন। তবে আমরা কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।”
মমিন মিয়ার মতে, ঘোড়ার গতি গরুর তুলনায় বেশি হওয়ায় অল্প সময়ে বেশি জমি চাষ করা সম্ভব। তাছাড়া ঘোড়ার খাবারের খরচও তুলনামূলকভাবে কম। ঘোড়া দিয়ে জমি চাষ করার পর মইও দেয়া যায়, যা জমি সমান করতে সহায়তা করে। এসব কারণে বাউরা এলাকার কৃষকদের কাছে মমিন মিয়ার ঘোড়ার হাল বেশ কদর পেয়েছে।
প্রযুক্তির এই যুগেও বৃদ্ধ মমিন মিয়া ঘোড়া দিয়ে হাল চাষের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি তার পরিবার চালানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তার এ বিরল উদ্যোগ স্থানীয় কৃষকদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।