বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষক ও জেলেদের অবদান অপরিসীম। দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষি ও মৎস্য খাতের সাথে যুক্ত। তবে, তাদের শ্রম এবং অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রতিবেদনটি কৃষক ও জেলেদের অর্থনৈতিক অবদান এবং তাদের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করবে।
বাংলাদেশের কৃষক ও জেলেরা দেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও শ্রম ও মেধা দিয়ে কৃষি এবং মৎস্য খাতে অবদান রাখেন, তবে তাদের ন্যায্য মূল্য, প্রযুক্তিগত সহায়তা, এবং আর্থিক সহায়তার অভাব রয়েছে। তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঠিক নীতিমালা, আর্থিক সহায়তা, উন্নত প্রযুক্তির সরবরাহ, এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক ও জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তাদের অবদান আরও শক্তিশালী করতে কার্যকর নীতিমালা ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের কৃষকরা খাদ্য উৎপাদনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তাদের শ্রম ও মেধা দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে অপরিহার্য। ধান, গম, পাট, আলু, ডাল এবং শাকসবজির মতো বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যেও কৃষকরা সৃজনশীল উপায়ে কৃষি কার্যক্রম পরিচালনা করেন, যা দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে কৃষকদের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, শাকসবজি এবং ফলমূলের মতো পণ্য বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়িয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে এসব পণ্যের উচ্চ চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি অর্গানিক পণ্য উৎপাদনের দিকে কৃষকদের মনোযোগ আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
কৃষি খাত দেশের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান ক্ষেত্র। এ খাতে সরাসরি কাজ করে দেশের প্রায় ৪০% জনগোষ্ঠী। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবহন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ শিল্পেও কর্মসংস্থান তৈরি হয়। কৃষিক্ষেত্র গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নারীরাও এই খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন, বিশেষত চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে।
কৃষি দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, বরং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং শিল্পখাতের কাঁচামাল সরবরাহ করে অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখে। তাই কৃষি খাতের উন্নয়নে কৃষকদের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রণোদনা, এবং উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে শুধু খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
কৃষক ও জেলেরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও তারা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। তাদের প্রধান সমস্যা হলো ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির অভাব। ফসল উৎপাদনের মৌসুমে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ মূল্য পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা ফসল কম দামে কিনে উচ্চ দামে বিক্রি করেন, যার ফলে কৃষক প্রকৃত মুনাফা থেকে বঞ্চিত হন। জেলেদের ক্ষেত্রেও মাছ ধরার মৌসুমে দাম কমে যাওয়ার কারণে লোকসানে মাছ বিক্রি করতে হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব জেলেদের অবস্থাকে আরও কঠিন করে তোলে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষক ও জেলেদের জীবিকার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। কৃষকরা বন্যা, খরা এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হন। হঠাৎ বন্যা বা শিলাবৃষ্টি ফসল নষ্ট করে দেয়। একইভাবে, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙনের কারণে জেলেদের মাছ ধরার কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ে। অনেক জেলে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জীবন ঝুঁকিতে ফেলেন।
তাছাড়া, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব তাদের উৎপাদনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে। কৃষকরা উন্নত সেচ ব্যবস্থা, যান্ত্রিক কৃষিকাজ, এবং আধুনিক বীজের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনেক সময় সঠিক কৃষি পরামর্শ বা প্রশিক্ষণও তাদের কাছে পৌঁছায় না। জেলেদের ক্ষেত্রেও উন্নত জাল, নৌকা, এবং মাছ সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি না থাকায় উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং অনেক মাছ নষ্ট হয়ে যায়।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কৃষক ও জেলেদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক, যাদের প্রয়োজনীয় মূলধন নেই। সারের দাম বৃদ্ধি, বীজ ও সেচের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আর্থিক সংকটে পড়েন। অনেক কৃষক ঋণ নিতে গিয়ে উচ্চ সুদের ফাঁদে পড়েন। জেলেদের ক্ষেত্রেও আধুনিক সরঞ্জাম কেনার মতো মূলধন নেই। ফলে তারা মহাজনদের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় কৃষক ও জেলেদের জন্য সঠিক নীতিমালা, আর্থিক সহায়তা, উন্নত প্রযুক্তির সরবরাহ এবং সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে তাদের জীবনমান উন্নত হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান আরও শক্তিশালী হবে।
কৃষক ও জেলেদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং তাদের জীবিকার উন্নয়নে কার্যকর নীতিমালা ও উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করা গেলে এ সেক্টরে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
কৃষক ও জেলেদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর বাজার ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ফসল ক্রয়ের উদ্যোগ নিতে পারে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে। জেলেদের ক্ষেত্রেও মাছের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে হিমাগার স্থাপন এবং রপ্তানিযোগ্য পণ্যের জন্য উপযুক্ত বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে সরকারি নীতিমালা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা জরুরি।
কৃষি ও মৎস্য খাতে আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অন্যতম মাধ্যম। কৃষকদের জন্য উন্নত বীজ, সেচ প্রযুক্তি, মাটির স্বাস্থ্য যাচাই সেবা এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করতে হবে। জেলেদের জন্য উন্নত নৌযান, জাল, মাছ সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং জিপিএস সিস্টেম সরবরাহ করা যেতে পারে। এসব প্রযুক্তি তাদের সময় ও খরচ বাঁচাতে সাহায্য করবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
কৃষক ও জেলেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এজন্য দুর্যোগের আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা আরও কার্যকর করতে হবে। বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও জেলেদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে দ্রুত আর্থিক সহায়তা প্রদান করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে।
কৃষক ও জেলেদের আর্থিক চ্যালেঞ্জ দূর করতে সহজ শর্তে কৃষি ও মৎস্য ঋণ প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি বা মাছ ধরার সরঞ্জাম কেনার জন্য সুদবিহীন বা স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দেওয়া উচিত। পাশাপাশি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা যেতে পারে। ফসল ও মৎস্যবীমা চালু করে দুর্যোগকালীন ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে।
কৃষক ও জেলেদের জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। বয়স্ক কৃষক ও জেলেদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা এবং তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা যেতে পারে। তাদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা দরকার।
দেশীয় কৃষিপণ্য ও মৎস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন বাজার সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। কৃষি ও মৎস্য খাতে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের সংযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। এ ছাড়া, রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে জেলে-কৃষকেরাই নেতৃত্বে ছিলেন। ফকির মজনু শাহ, নূরলদীন, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, টিপু পাগলারা ছিলেন কৃষকনেতাই। এটি ছিল ব্রিটিশের অধীন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তৈরি হওয়ার আগপর্যন্ত। তার পর থেকে (শেরেবাংলা ও মাওলানা ভাসানী ছাড়া) যত পার্টি তৈরি হয়েছে, সবাই কৃষকবিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে গ্রামের জেলে ও তাঁতির যেমন নেতৃত্ব ছিল, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে তা নেই। এই অভ্যুত্থানকে তাঁদের ঘরে নিয়ে যাওয়ার উপায় কী?
১৯৫৪ সালে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা ছিল, “বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ এবং খাজনা হ্রাস ও সার্টিফিকেট মারফত খাজনা আদায় রহিত করা হবে।” জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও কৃষক ও জেলেদের জীবনমান উন্নত হয়নি। হাট-ঘাটে জমিদারদের মতো রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আধিপত্য আজও রয়েছে।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সুশাসিত করে কৃষক ও জেলেদের সরাসরি সহযোগিতার সুযোগ বাড়ানো দরকার। জেলার নিজস্ব প্রশাসন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা স্থানীয়ভাবে দিলে তাদের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব। এছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ, নদী এবং জলাশয়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত।
সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশকে একটি কার্যকর এবং সুষম অর্থনৈতিক কাঠামো গড়তে হলে কৃষক ও জেলেদের প্রতি সুবিচার এবং সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।