চলমান অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে কমে আসা আমদানি প্রবণতা গত ডিসেম্বর থেকে উল্টো পথে হাঁটছে। বিশেষ করে চাল ও ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিতে বড় ধরনের উল্লম্ফন লক্ষ্য করা গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমদানি বাড়লেও বাজারে চালের দাম কমেনি, বরং বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকট কমে আসা, আমদানির বিধিনিষেধ শিথিল, শুল্ক হ্রাস এবং এলসি মার্জিন সহজ করাসহ নানা উদ্যোগের ফলে আমদানি বাড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৩০ শতাংশ বেশি। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময় আমদানি ১১ শতাংশ কমে গিয়েছিল। নভেম্বর পর্যন্তও আমদানি প্রবণতা ঋণাত্মক ছিল।
২০২২ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া ডলার সংকট মোকাবিলায় সরকার কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। শতভাগ এলসি মার্জিন, বাড়তি শুল্ক এবং নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের আগস্টে সরকারের পতনের পর এই নীতিমালায় বড় পরিবর্তন আসে। এখন যে কেউ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন। এলসি মার্জিন নির্ধারণ এখন ব্যাংক ও আমদানিকারকের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এরই ফলস্বরূপ, রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি এসেছে প্রায় ২৪ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়ে ১০ শতাংশ। অর্থ পাচার হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ২০.০৯ বিলিয়ন ডলার, আর ডলারের বিনিময় হার ১২২-১২৩ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল রয়েছে।
পণ্যভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চালের আমদানি, যা গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ২৮ কোটি ৬১ লাখ ডলারে—আগের বছরের তুলনায় যা ২০৫ গুণ বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ডালে, যেখানে ৮০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের ডাল আমদানি হয়েছে, যা আগের তুলনায় ১২৮.৫ শতাংশ বেশি। তবে গমের আমদানি কমেছে ৭ শতাংশ, দাঁড়িয়েছে ১০৬ কোটি ডলারে।
তবে বাজারে চালের দামে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম ১২.৭৭ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম ১১.৮২ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৩ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে সরু চাল প্রতি কেজি ৭২ থেকে ৮৭ টাকা, মাঝারি ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা এবং মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে, অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামে খানিকটা স্বস্তি এসেছে। পেঁয়াজ, রসুন, আলু, আটা, চিনি, সবজি, এমনকি ডালের দামও কিছুটা কমেছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। যদিও মার্চ মাসের হিসাব এখনো প্রকাশিত হয়নি, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৩২ শতাংশে নেমেছে, যা গত ২৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এছাড়া আরও কিছু আমদানি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে—ভোজ্যতেল আমদানি ১৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৪ কোটি ডলারে, মসলা আমদানি ৯ শতাংশ বেড়ে ৩০ কোটি ৬২ লাখ ডলারে, এবং চিনি আমদানি ২.৬ শতাংশ কমে ৭৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তৈরি পোশাক সম্পর্কিত পণ্যের আমদানি বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ, মোট ১ হাজার ২৬৬ কোটি ডলারের পণ্য এসেছে। তবে মূলধনি পণ্যের আমদানি ১১ শতাংশের বেশি কমেছে। অন্যদিকে, অন্যান্য আমদানি ১১ শতাংশ বেড়ে ৬৫০ কোটি ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন ব্যবসায়ীরা সহজেই ডলার পাচ্ছেন এবং অধিকাংশ আমদানি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে কঠোর নজরদারি ও প্রচলিত প্রণোদনা ব্যবস্থার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়ছে।