ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য জ্ঞান আহরণের কেন্দ্রস্থল। প্রতিষ্ঠার এক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত এবং প্রশাসনিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আজও রয়ে গেছে। বিশেষত, নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট আজ একটি প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদন সেই সংকটের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজে দেখবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৪০,০০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী শিক্ষার্থী। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সুবিধা এই বিপুল শিক্ষার্থী সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যমান আবাসন সুবিধাগুলি অল্প কয়েকটি হলের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সুফিয়া কামাল হল, শামসুন্নাহার হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল এবং রোকেয়া হল।
প্রতিটি হলে ধারণক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি শিক্ষার্থী বসবাস করছে। উদাহরণস্বরূপ, সুফিয়া কামাল হলে যেখানে ১,০০০ শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে প্রায় ২,৫০০ শিক্ষার্থী অবস্থান করছে। এই অতিরিক্ত চাপে শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা সংকুচিত হচ্ছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং শিক্ষার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন সংকটের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু প্রধান কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান আবাসন সুবিধাগুলি অপর্যাপ্ত। নতুন হল নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির সময় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের জন্য নির্ধারিত আবাসন সুবিধা বাড়েনি। ফলে, হলগুলিতে ঠাঁই পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকা একটি ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প। ফলে, তাদের প্রধান ভরসা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি এবং নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা যথাযথভাবে করা হয়নি।
এই সংকট নারী শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনে বহুমুখী প্রভাব ফেলছে, আবাসিক সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী যথাযথ পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারছে না। অপ্রতুল জায়গা, ঘনবসতির কারণে ব্যস্ততা এবং পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার মতো সমস্যাগুলি তাদের শিক্ষার মানকে প্রভাবিত করছে।
সংকুচিত ও অনিরাপদ পরিবেশে বসবাস নারী শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। অনেকেই এই চাপ মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী একসঙ্গে থাকার কারণে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। জলাবদ্ধতা, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং ক্যান্টিনের খাবারের নিম্নমান এসব সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
শামসুন্নাহার হলের এক শিক্ষার্থী জানান, “আমরা পাঁচজন মিলে একটি ছোট রুমে থাকি। পড়াশোনার জন্য জায়গা তো দূরের কথা, শ্বাস নেওয়ারও পর্যাপ্ত জায়গা পাই না।”
রোকেয়া হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “পর্যাপ্ত সিট না পেয়ে অনেক সময় রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয়। সকালে ক্লাসে মনোযোগ দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে।” শিক্ষার্থীদের এই অভিজ্ঞতা সংকটের গভীরতা বোঝাতে যথেষ্ট।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংকট সমাধানে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নতুন হল নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তবে তা বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই প্রকল্পগুলো শেষ হলে কিছুটা হলেও সমস্যা লাঘব হবে। তবে, প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এবং স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন আবাসিক হল নির্মাণ করা প্রয়োজন। বর্তমানে ব্যবহৃত আবাসন নীতিমালাগুলোর আধুনিকায়ন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সংকট নিরসনে অস্থায়ী শেল্টার বা ক্যাম্পাসের কাছাকাছি ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থা করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকলেও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে আবাসিক হল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা, যা শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের জীবনের মান উভয়কেই প্রভাবিত করছে। এ সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক এবং সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা একটি মৌলিক দায়িত্ব, যা পূরণ করা ছাড়া শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সুত্র: প্রথম আলো