বাংলাদেশ দ্বীপদেশ না হলেও নদীমাতৃক দেশ হিসেবে এর ভূখণ্ডে অসংখ্য চর রয়েছে। এর মধ্যে নিঝুম দ্বীপ এক অনন্য প্রকৃতির লীলাভূমি। বঙ্গোপসাগরের বুকে, মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত এই দ্বীপটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক স্বপ্নের গন্তব্য।
নিঝুম দ্বীপ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়া উপজেলার একটি ছোট দ্বীপ। এটি হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। চারটি চর—চর ওসমান, বাউল্লার চর, কামলার চর এবং মৌলভির চর মিলে গঠিত হয়েছে নিঝুম দ্বীপ। প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর আয়তনের এই দ্বীপটি ১৯৪০ সালে সাগরের মাঝে জেগে ওঠে। ১৯৫০-এর দশকে এখানে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে এবং ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে।
প্রথম দিকে নিঝুম দ্বীপের নাম ছিল চর ওসমান এবং বাউল্লার চর। কথিত আছে, এই দ্বীপে বসতি গড়ার প্রথম ব্যক্তি ছিলেন ওসমান নামের এক বাথানিয়া। তার নামানুসারেই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য হয়ে যায়। এরপর হাতিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য আমিরুল ইসলাম কালাম দ্বীপটি পরিদর্শন করেন এবং দ্বীপের নির্জনতা দেখে এর নাম পরিবর্তন করে ‘নিঝুম দ্বীপ’ রাখেন।
নিঝুম দ্বীপ মূলত তার চিত্রা হরিণের বিশাল ঝাঁক এবং শীতকালীন অতিথি পাখিদের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে এতোসংখ্যক চিত্রা হরিণ একসঙ্গে দেখা যায় না। এ ছাড়া, সন্ধ্যা হলে দ্বীপে শিয়ালের ডাক এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে।
পাখি ও হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে যাত্রা শুরু করতে হয়। স্থানীয় ছোট ছেলেরা পর্যটকদের গাইড হিসেবে সহযোগিতা করে। তারা ম্যানগ্রোভ বনের হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসে।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য নিঝুম দ্বীপের সেরা স্থান হলো নামা বাজার সৈকত। এখানে বসে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দের সাথে মনোরম সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়।
শীতকালে অতিথি পাখির মেলা বসে কবিরাজের চর ও দমার চরে। পড়ন্ত বিকেলে নৌকা বা ট্রলারে কবিরাজের চরের কাছে গেলে চিত্রা হরিণের দল চোখে পড়বে।
টাটকা ইলিশ খাওয়ার জন্য কমলার দ্বীপ অন্যতম সেরা জায়গা। এছাড়া, দমার চরের দক্ষিণে নতুন সৈকতটিকে ‘ভার্জিন আইল্যান্ড’ বলা হয়। এই জায়গাটি পাখিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গতুল্য।
নিঝুম দ্বীপ ঘুরতে যাওয়ার জন্য সর্বোত্তম সময় হলো অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস। শীতকালে রাস্তাঘাট শুকনো থাকে, ফলে সহজে সব জায়গায় যাওয়া যায়। বর্ষাকালে পুরো দ্বীপ হাঁটুসমান কাদায় ভরে যায়, ফলে চলাচল বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবে, বর্ষায় প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে নোয়াখালীর সোনাপুর যেতে বাসে জনপ্রতি ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকা। সোনাপুর থেকে চেয়ারম্যান ঘাট যেতে সিএনজিতে ভাড়া পড়ে ৫০০-৬০০ টাকা। চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ট্রলার, স্পিডবোট ও সি-ট্রাকের মাধ্যমে হাতিয়া যাওয়া যায়।
সরাসরি ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন বিকেল ৫:৩০ টায় একটি লঞ্চ হাতিয়ার তমুরদ্দী ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
তমুরদ্দি ঘাট থেকে মোটরসাইকেলে মোক্তারিয়া ঘাট হয়ে ট্রলারে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়।
নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার ও বন্দরটিলা এলাকায় বেশ কয়েকটি মানসম্পন্ন রিসোর্ট রয়েছে। জনপ্রতি রুম ভাড়া ১৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
নামার বাজারের খাবার হোটেলগুলো সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি ভাজার জন্য বিখ্যাত। আগে থেকে অর্ডার দিলে উন্নতমানের খাবার পাওয়া যায়।
১. আবহাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নেওয়া উচিত। 2. দ্বীপে বিদ্যুৎ না থাকায় পাওয়ার ব্যাংক ও টর্চ সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন। 3. পরিবেশ দূষণ রোধে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা উচিত। 4. বিভিন্ন যানবাহন ভাড়া নেওয়ার আগে দর কষাকষি করে নেওয়া উচিত।
নিঝুম দ্বীপ প্রকৃতির এক অনন্য দান। হরিণ, অতিথি পাখি, বনভূমি এবং সমুদ্রের সংমিশ্রণে এটি এক মনোমুগ্ধকর পর্যটন কেন্দ্র। নির্জনতা ভালোবাসেন এমন প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য নিঝুম দ্বীপ হতে পারে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।