আজ ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবস, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অমর ও ঐতিহাসিক দিন। এ দিনই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার মহান বিজয় অর্জন করেছিল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও লাখ লাখ প্রাণের ত্যাগের পর আজকের এই দিনটি বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছিল। এই দিন, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অবস্থান সুনিশ্চিত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা পৃথিবীর নানা প্রান্তে সমাদৃত হয়েছে।
বিজয়ের ইতিহাসের শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, যখন পাকিস্তানি বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবিশ্বাস্য অত্যাচার চালায়। পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা বাংলার জনগণের প্রতি অবহেলা ও শোষণের মাধ্যমে এ দেশে শুরু হয়েছিল অন্যায্য শাসনের এক দীর্ঘ অধ্যায়। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞার সম্মুখীন হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এসব আন্দোলন জাতির মুক্তির পথ রচনা করেছিল।
তবে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছিল। ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, যা পাকিস্তান সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া ছিল অসম্ভব। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা দেখায় এবং শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে চালায় এক ভয়াবহ গণহত্যা। ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে নিরীহ বাঙালি মানুষের উপর আক্রমণ করা হয়, যা পরবর্তীতে ‘বিভীষিকা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এর পর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম একাধিক মাইলফলক অতিক্রম করে, যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহসিকতা ও কষ্টের সাক্ষী হয়ে ওঠে সমগ্র জাতি।
বিজয় অর্জনের জন্য বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যেখানে তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তার এই ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার উৎস। এই ভাষণের পর, দেশব্যাপী শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার এবং অন্যদিকে বাঙালি জনগণের দৃঢ় প্রতিরোধ।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সঙ্গে যৌথ বাহিনী গঠন এবং পরবর্তীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে, এবং এই দিনটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে বিজয় দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিজয় দিবস শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, এবং জনগণের আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। আজকের দিনে, আমরা স্মরণ করি সেই সব বীর সেনানীদের, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের, যারা নিজেদের জীবন দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। বিজয় দিবসের দিনে, পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে, যারা স্বদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
এই দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলার জনগণ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। বিজয় দিবস আমাদের প্রেরণা দেয় যেন আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকি।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ ছিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বাঙালি জাতি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পরবর্তী দশকগুলোতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ লড়াই চালিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর পরও বাংলাদেশের জনগণের উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়নি আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতের নানা বাধা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই বিজয় দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতিগত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতির সম্মিলিত প্রয়াস কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিজয় দিবস কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনা এবং স্বপ্নের পুনর্জাগরণের দিন।
বিজয় দিবসের সাথে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাটির একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ পতাকা কেবল একটি জাতীয় চিহ্ন নয়, এটি বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম, ঐক্য এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নতুন একটি পতাকা গড়ে ওঠে, যা আজ বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশের জাতিগত মর্যাদা এবং স্বাধীনতার প্রদর্শক হিসেবে পরিচিত।
বিজয় দিবসের পরবর্তী সময়টিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ এবং স্বাধীনতার ঘোষণা প্রমাণ করেছিল যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে।
১৯৭১ সালের বিজয়ের পর, বাংলাদেশ স্বপ্নের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। যদিও বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, তবে এর জনগণ কখনও তাদের স্বাধীনতার মূল্য ও অঙ্গীকার ভুলে যায়নি। বিজয় দিবস আমাদের একটি বার্তা দেয়, তা হল—যত বড়ই বাধা আসুক, ঐক্য ও সংগ্রামের মাধ্যমে সবকিছু অর্জন করা সম্ভব।
আজকের বিজয় দিবস একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা। স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস চিরকাল আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা তাদের অবদান চিরকাল স্মরণ করব। বিজয় দিবসের এই মহান দিনটি আমাদের শিখায়, সংগ্রাম, একতা, এবং সাহসের মাধ্যমে যে কোন প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব।