ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (১২ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হলো ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি, যেখানে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ-এর ডাকে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মুখর হয়ে ওঠে রাজধানী। কর্মসূচিটি বিকেল ৩টার কিছু পরে শুরু হয়ে ৪টার দিকে ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
কর্মসূচির সমাপনী ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, “গাজা কেবল একটি শহর নয়, এটি আমাদের ঈমানের অংশ। এই কর্মসূচি ইতিহাসের সামনে আমাদের একটি অঙ্গীকার, একটি জবাব এবং একটি শপথ।”
তিনি গাজার পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা, মুসলিম বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং বাংলাদেশের অবস্থানের দিক নির্দেশনা তুলে ধরেন।
সকাল থেকেই রাজধানী ও আশপাশের জেলা থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ঢাকায় আসতে শুরু করেন। হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা ও স্লোগানসম্বলিত প্ল্যাকার্ড। ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’, ‘গাজা রক্তে রঞ্জিত, বিশ্ব কেন নীরব’, ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’—এমন নানা শ্লোগানে গমগম করতে থাকে রাজধানী।
ঢাকা মহানগরীর প্রায় প্রতিটি মোড়, বিশেষত শাহবাগ, টিএসসি, বাংলামোটর, ফার্মগেট, রামপুরা, কাওরান বাজার, শান্তিনগরসহ প্রায় ৩ কিমি জুড়ে যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ট্রাফিক বিভাগ জানায়, “এত বিশাল জনসমাগমের কারণে আমাদের সব বিকল্প রুটও বন্ধ হয়ে গেছে, শহর যেন থেমে গেছে।”
বিক্ষোভকারীদের জন্য রাস্তায় দেখা যায় পানির ট্যাংক। নানা স্বেচ্ছাসেবকরা অংশগ্রহণকারীদের পানিপান করাচ্ছিলেন। তবে এই বিরাট সমাবেশে ছিল না কোনো বিশৃঙ্খলা। আশেপাশের এলাকাগুলোতেও দোকানে ফিলিস্তিনের পতাকা, ব্যাজ ও টি-শার্ট বিক্রি বেড়ে যায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি দাবি:
ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে নিশ্চিত করা।
যুদ্ধবিরতি নয়, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্ত ফিরিয়ে দেওয়া।
পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি।
ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা।
মুসলিম বিশ্বের প্রতি দাবি:
ইসরায়েলের সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন।
বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ।
গাজার জনগণের জন্য চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত।
আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলকে একঘরে করার উদ্যোগ।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কার্যকর অবস্থান গ্রহণ।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান:
পাসপোর্টে ‘Except Israel’ শর্ত পুনর্বহাল।
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি বাতিল।
গাজায় রাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রেরণ।
জায়নবাদী কোম্পানির পণ্য বর্জনে সরকারি নির্দেশ।
ভারতের মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ।
পাঠ্যবইয়ে ফিলিস্তিন ও মুসলিমদের সংগ্রামের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত।
নিজেদের প্রতি অঙ্গীকার:
ইসরায়েল-সমর্থিত পণ্য বর্জন।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আদর্শিকভাবে প্রস্তুত করা।
সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুতির মানসিকতা গড়ে তোলা।
ঐক্যবদ্ধ থাকা ও বিভাজন থেকে দূরে থাকা।
ঘোষণাপত্রে ফিলিস্তিনের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। বলা হয়, “গাজার শহীদরা কেবল আমাদের দোয়া চান না, তারা আমাদের প্রস্তুতি চান।” মাহমুদুর রহমান বলেন, “এই গর্বিত জমিন যেন পরিণত হয় সেই পাথরে, যেখানে ভেঙে পড়বে জায়নিস্টদের সব ষড়যন্ত্র।”
‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি শুধু একটি প্রতিবাদ ছিল না—এটি ছিল বিশ্বাস, ঈমান, ঐক্য এবং দায়বদ্ধতার এক সম্মিলিত উচ্চারণ। বাংলাদেশের মাটিতে এমন বিশাল গণজমায়েত বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল, ফিলিস্তিনের পাশে এক অটুট জনতা আজও জেগে আছে।