সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরে মোট ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে মোট ৬ হাজার ৯৭৪টি দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ২৩৭ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ১৯০ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলায়, উপজেলায় বাস, ট্রাক, পিকআপ, সিএনজি ও অটোরিকশার সংঘর্ষের ঘটনায় অসংখ্য প্রাণহানি ঘটছে। কোথাও একই পরিবারের ৪-৫ জন সদস্য একসাথে সিএনজি বা অটোরিকশার ভেতরে ট্রাকের চাপায় মারা যাচ্ছেন। আবার বাসের সাথে বাসের সংঘর্ষে বহু মানুষ নিহত ও আহত হচ্ছেন। এ সকল দুর্ঘটনা দেশের মানুষের জীবনে নেমে এনেছে এক নির্মম দুর্ভোগ।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক, ট্রাফিক আইন অমান্য করা এবং সড়কের ত্রুটিপূর্ণ অবস্থা। এছাড়াও সিএনজি, অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালকদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট লাইসেন্স বা রোড পারমিট না থাকা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ট্রাক বা বাসের চালকরা তাদের কন্টাক্টার বা হেলপারকে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যার ফলে ঘটে যাচ্ছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
অপরদিকে, কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রশাসনের দুষ্কৃতিকারী সদস্যরা মাসিক চাঁদা নিয়ে ফিটনেসবিহীন ও রোড পারমিটবিহীন যানবাহনগুলোকে চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এতে হাইওয়ে রোডগুলোতে অপ্রয়োজনীয় যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকার ও প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে শক্ত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে কোনো ড্রাইভার টানা ড্রাইভিং করতে না পারে। একজন ড্রাইভারকে একদিন ড্রাইভ করার পরে পরবর্তী দিন বিশ্রাম নিতে বাধ্য করা উচিত।
এছাড়াও, প্রতিটি গাড়িতে একটি চেকলিস্ট রাখতে হবে, যা ট্রাফিক পুলিশ যেকোনো সময় চেক করতে পারবেন। এতে দেখা যাবে, কোন ড্রাইভার কতদিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন এবং কোনো চালক টানা ড্রাইভিং করছেন কিনা। পরিবহন মালিক ও মালিক সমিতিকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হলো অটোরিকশা ও সিএনজি চালকদের অদক্ষতা। তাদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে এবং রোড পারমিট ছাড়া রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
প্রতিটি চালককে বিআরটিএ থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হবে এবং সড়কের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে এবং সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমবে।
বর্তমানে দেশের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হারও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মোটরসাইকেল ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। তাদের বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
এজন্য প্রত্যেকটি পিতা-মাতাকে সচেতন করতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কোনো কিশোরকে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া বা চালানোর সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনে মোটরসাইকেল ব্যবহারের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো পরিবহন মালিকদের অসচেতনতা এবং কেবল ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। পরিবহন মালিক সমিতিকে অবশ্যই ড্রাইভারদের সঠিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন রাস্তায় নামানো বন্ধ করতে হবে।
২০২৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যে প্রাণহানি ঘটেছে, তা অতীতের যে কোনো মহামারী বা মরণব্যাধির তুলনায় বেশি। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী অকেজো হয়ে পড়বে এবং পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি কার্যকরী সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান আইনের অসংগতি এবং শিথিলতা দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। সরকারকে দ্রুত একটি আধুনিক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করতে হবে, যা কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে। এ আইনে চালকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত এবং যেকোনো নিয়ম ভঙ্গের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং সড়কে নিয়মিত নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের কার্যক্রম আরও জোরদার করা জরুরি। ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব হলো সড়কের শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তবে প্রায়ই দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়। তাদের কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। বিশেষ করে হাইওয়ে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো এবং গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার যাতে তারা আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে।
দেশের গণপরিবহন চালকদের একটি বড় অংশই প্রশিক্ষণবিহীন। ফলে তারা সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালায়, যা দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চালকদের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার আগে কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাই করতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চালকদের ট্রাফিক আইন, নিরাপদ ড্রাইভিং পদ্ধতি এবং যাত্রীদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। প্রশিক্ষিত চালকরা দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি, চালকদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানোও জরুরি।
গণপরিবহন খাতে মালিক সমিতিগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজ করে এবং চালকদের বেপরোয়া আচরণের জন্য কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। মালিক সমিতির কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক করতে হবে। পরিবহন মালিকদের উচিত তাদের গাড়ির ফিটনেস, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং রোড পারমিট নিশ্চিত করা। যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মালিক সমিতির ওপরও দায়িত্ব দিতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া, চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও বিশ্রামের সুযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে রোড পারমিট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। বর্তমানে অনেক যানবাহন বেআইনিভাবে রাস্তায় চলাচল করছে, যেগুলোর কোনো রোড পারমিট নেই। এ ধরনের যানবাহন ট্রাফিক শৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিআরটিএ-এর কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ ও আধুনিক করতে হবে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে রোড পারমিট ও লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য চালকদের কঠোর পরীক্ষার মুখোমুখি করতে হবে এবং লাইসেন্স নবায়নের সময় চালকদের দক্ষতা পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। এ প্রক্রিয়াকে দুর্নীতিমুক্ত ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে।
সড়কে চাঁদাবাজি একটি বড় সমস্যা। পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা হয়, যা তাদের আর্থিক চাপে ফেলে এবং দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়ায়। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। বিশেষ করে হাইওয়ে রাস্তায় চাঁদাবাজির ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা আইন মেনে চলতে উৎসাহিত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে দেশের মানুষের জন্য একটি ভয়াবহ সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার, প্রশাসন, পরিবহন মালিক সমিতি এবং সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দুর্ঘটনার এই মহামারী থেকে মুক্তি পেতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। নতুবা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামো ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে।