শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত “কেমন সংবিধান চাই” শীর্ষক আলোচনা সভায় নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ১০০টি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আসন রাখার প্রস্তাব দেন এবং বর্তমানে সংরক্ষিত ৫০টি আসনের পদ্ধতিকে “নারীদের প্রতি অপমান” বলে অভিহিত করেন।
নারীদের জন্য ১০০ আসনের প্রস্তাবনায় ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “নারীদের জাতীয় সংসদে ১০০টি আসন নিশ্চিত করতে হবে, তবে তা হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। সংরক্ষিত আসনের বর্তমান পদ্ধতিতে অর্থের লেনদেন হয়, যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে বড় বাধা।”
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার নতুন প্রস্তাবনায় আইনসভাকে দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, জাতীয় সংসদ ,সদস্য সংখ্যা থাকবে ৩০০। সংরক্ষিত মহিলা আসন থাকবে না, রাজনৈতিক দলগুলোকে ১০% নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে, সংসদ সরকারের প্রতি আস্থা-অনাস্থা ভোট এবং বাজেট পাশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাখবে।
জাতীয় পরিষদ সদস্য সংখ্যা ২০০, সদস্যরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হবেন। ২৫টি আসন সংরক্ষিত থাকবে নারীদের জন্য, যা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে বণ্টিত হবে। তৃতীয় লিঙ্গ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে ১০টি আসন, জাতীয় পরিষদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এবং আইন প্রণয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ করবে।
নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রস্তাবনা খসড়া প্রস্তাবে নির্বাচন পরিচালনায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো নিয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় পরিষদের নির্দলীয় সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠিত হবে, কমিটির সুপারিশে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাদের নিয়োগ দেবেন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ ব্যক্তি নির্বাচনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে ভোটের অধিকার, ভোটের হার ৫০% এর নিচে হলে নির্বাচন বাতিল হবে। কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠান ভোটের অধিকার ক্ষুণ্ণ করলে তা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
সংবিধান লঙ্ঘনের নজরদারি প্রস্তাবে একটি সাংবিধানিক আদালত গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা সংবিধান লঙ্ঘনের বিষয়সমূহ নিজ উদ্যোগে পর্যবেক্ষণ করবে। আদালত সংবিধান লঙ্ঘনের কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারবে। অন্য প্রস্তাবনাগুলো
নতুন সংবিধানের খসড়া প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মেয়াদে সীমাবদ্ধতা আরোপ করার সুপারিশ করা হয়েছে। কেউই দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ সম্ভব হবে এবং নেতৃত্বে নতুনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। প্রস্তাবনায় এ পদক্ষেপকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি দপ্তরগুলোর কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে ন্যায়পাল নিয়োগের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। ন্যায়পাল একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে, যার মূল দায়িত্ব হবে, সরকারি কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি ঘটলে তার তদন্ত করা। রাষ্ট্রের সংবিধানিক কাঠামোর লঙ্ঘন হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। নাগরিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা। প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়েছে, ন্যায়পালের দায়িত্ব হবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা, যাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়।
খসড়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক আচরণ নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠন করবে রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী সংগঠন থাকতে পারবে না।দলগুলোর চাঁদা গ্রহণ এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী মনোনয়নে ১০ শতাংশ আসনে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এ উদ্যোগগুলো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা বাড়ানোর পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসারে সহায়ক হবে।
অনুষ্ঠানে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এম. আসাদুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিচারপতি এম. এ মতিন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ বিশিষ্ট নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
নতুন সংবিধানের এই খসড়া প্রস্তাবনা রাজনৈতিক কাঠামো, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, এবং নাগরিক অধিকারে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে জাতীয় ঐক্যমতের ওপর।