চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা। তবে নারীদের প্রান্তিকীকরণ সেই আকাঙ্ক্ষার পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শুক্রবার (২২ নভেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘গণঅভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ: নারীরা কোথায় গেলো’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আলোচনা সভায় উঠে আসে, চব্বিশের আন্দোলনে নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তাদের অবদান স্বীকৃতি পায়নি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লড়াকু ২৪ ও এমপাওয়ারিং আওয়ার ফাইটার্স আয়োজিত এই সভায় আন্দোলনের অন্যতম নারী নেত্রী ও অংশগ্রহণকারীরা দাবি করেন, ঐতিহাসিকভাবে নারীদের বঞ্চিত করার যে সংস্কৃতি ছিল, তা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও বহাল আছে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিফা জান্নাত বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে এখনো নারীদের নিজেদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। অথচ রাষ্ট্রের উচিত ছিল এই অবদান স্বীকার করা। নারীদের বাদ দিয়ে কখনোই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘আমরা নারীরা নেতৃত্ব দিয়েছি, কিন্তু আন্দোলনের পরে আমাদের কর্নার করার পরিকল্পিত প্রক্রিয়া শুরু হয়। যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানি করা হয়েছে এবং কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।’
বরিশালের আন্দোলনে অংশ নেওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস নীতু জানান, ‘আন্দোলন পরবর্তী সময়ে উপদেষ্টা পরিষদে কোনো নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এমনকি মুখপাত্র হিসেবে থাকা নারীর কার্যক্রমও প্রায় অনুপস্থিত। এটি হতাশাজনক।’
আন্দোলনের সময় আহতদের সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক অর্থি জুখরিফ বলেন, ‘সংস্কার কমিশনে নারীদের উপস্থিতি প্রয়োজনীয়। বৈষম্য দূর করতে এখানে সমানভাবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।’
শ্রমজীবী নারীদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আশুলিয়ার আন্দোলনে অংশ নেওয়া সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘নারী শ্রমিকরা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অনেকেই আহত-নিহত হয়েছেন। কিন্তু তাদের ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি।’
আন্দোলনের সময় আহত সাংবাদিক শামীমা সুলতানা লাভু জানান, ‘গণমাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের ভূমিকা প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। অনেক সময় বাধার মুখে তথ্য প্রচার করতে না পারলেও বিদেশি মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছি।’
আলোচনা সভার উদ্বোধন করেন আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী নাইমা সুলতানার মা আইনুন নাহার। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার মেয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। তার মৃত্যু আমাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে। আমরা চাই, আন্দোলনের শহীদদের যথাযথ মূল্যায়ন হোক এবং তাদের গল্প পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।’
আলোচনা সভার অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য নারীদের সক্রিয় অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারা নারীদের নেতৃত্ব এবং প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর আহ্বান জানান। পাশাপাশি, নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ জরুরি বলে অভিমত দেন।
আলোচনা সভা শেষ হয় নারীদের ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন এবং একটি বৈষম্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের আহ্বানের মধ্য দিয়ে।