২০২৪ সালের ৪ আগস্ট, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের আগের দিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক জুনায়েদ ভূঁইয়া। আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আগে স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন, “আমি মারা গেলে আল্লাহ তোমাদের দেখবে।”
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার হাসনাবাদ পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা জুনায়েদ বেড়ে ওঠেন গুলশান ও মিরপুর-১০ এলাকায়। তিনি রিকশা চালিয়ে তার পরিবার পরিচালনা করতেন। স্ত্রী হাফসা আক্তার (২১) ও চার বছরের মেয়ে মরিয়মকে নিয়ে মিরপুর-১০ জুটপট্টি জল্লাদখানা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
৪ আগস্ট দুপুরে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। জুনায়েদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে তার বন্ধুরা সরে গেলেও তিনি রয়ে যান। বেলা ২টার দিকে পুলিশের গুলি তার মাথায় বিদ্ধ হয়।
তৎক্ষণাৎ উপস্থিত জনতা তাকে আশপাশের হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও কোথাও ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। পরে জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে অবস্থার অবনতি দেখে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। মাথা থেকে গুলি অপসারণের পর রাত ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পরদিন ৫ আগস্ট বাদ জোহর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
নিহত জুনায়েদ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে জানিয়েছেন তার বাবা আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া (৫৫)। তিনি বলেন, “শুরুতে সে আন্দোলনে তেমন যেত না। কিন্তু যখন ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হলো, তখন থেকে নিয়মিত আন্দোলনে যেতে লাগল। ২৫ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে তার পায়ে গুলি লাগে। আমরা নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু সে শোনেনি।”
তার স্ত্রী হাফসা আক্তার বলেন, “আমি বারবার তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম—তোমার পায়ে গুলি লেগেছে, এবার আর যেও না। আমাদের কী হবে? কিন্তু সে বলেছিল—ছাত্ররা যদি আন্দোলন করতে পারে, আমি ঘরে বসে থাকব কেন? পুলিশ আমার ভাইদের গুলি করে মারছে, আমি ঘরে বসে থাকতে পারব না। দরকার হলে শহীদ হব।”
চার বছরের মেয়ে মরিয়ম বলেছে, “আমি আব্বুকে বলেছিলাম, তুমি আর আন্দোলনে যেও না। আব্বু আমার কথা শোনেনি। পুলিশ আমার আব্বুর মাথায় গুলি করেছে। আমি আব্বুর হত্যার বিচার চাই।”
জুনায়েদের মৃত্যুর পর তার পরিবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। তার বাবা আনোয়ার হোসেন দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছেন এবং হাঁপানি রোগে ভুগছেন।
সম্প্রতি, জুনায়েদের স্ত্রী হাফসা আক্তারকে তার ছোট ভাই আরিফুল ভূঁইয়ার (২৫) সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন তার বাবা।
আনোয়ার হোসেন বলেন, “নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার এক ছেলে শহীদ হয়েছে, একমাত্র মেয়ে করোনায় মারা গেছে। হাফসাকে মেয়ে মনে করেই ছোট ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি।”
আরিফুল বলেন, “পরিবারের সবার কথামতো আমি রাজি হয়েছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
জুনায়েদের পরিবার ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
জুনায়েদের বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই। কিন্তু মামলা করলে আমাদের বাড়িতে হয়রানি করা হতে পারে। তাই চুপচাপ আছি।”